রবি ৫, বাংলালিংককে ১৫ শতাংশ বিদেশি মালিকানা ছাড়তে হবে
টেলিযোগাযোগ খাত

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৭ পিএম
দেশের অনেক টেলিযোগাযোগ কোম্পানিতে বিদেশি মালিকানা রয়েছে শতভাগ। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে বিদেশি বিনিয়োগ হবে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ। ফলে যেসব কোম্পানির শতভাগ বিদেশি মালিকানা রয়েছে, তাদের বাড়তি শেয়ার দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা শেয়ারবাজারে হস্তান্তর করতে হবে। বিশেষ করে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংককে ১৫ এবং রবিকে ছেড়ে দিতে হবে ৫ শতাংশ বাড়তি শেয়ার।

আপত্তিকর ভিডিও স্পটিফাই অ্যাপে!
নতুন নীতিমালার মাধ্যমে ফাইবার অপটিক্স, টাওয়ারসহ টেলিযোগাযোগের অবকাঠামো খাতে বিদেশি বিনিয়োগের পথও উন্মুক্ত হয়েছে। বর্তমানে এ খাতে প্রাধান্য রয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। বিদ্যমান নিয়মে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সেবার জন্য ২৬ ধরনের লাইসেন্স দিয়ে আসছিল। এখন থেকে চার ধরনের লাইসেন্স দিয়েই টেলিযোগাযোগ খাতের সব সেবা মিলবে। গত বছর অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর টেলিযোগযোগ নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। ‘টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং’ নামে এ নীতিমালা গত ৪ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দেয়। গত সোমবার এ সংক্রান্ত গেজেট জারি হয়েছে।
সরকার বলছে, প্রযুক্তি ও বাজারের দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় পুরোনো নীতিমালা হয়ে উঠেছিল অকার্যকর। অব্যবহৃত ফাইবার নেটওয়ার্ক, সাবমেরিন কেবল ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা, দুর্বল অবকাঠামো, একাধিক স্তরে লাইসেন্স জটিলতা এবং সেবার নিম্নমান– সব মিলিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের অগ্রযাত্রা থমকে যাচ্ছিল। এ পটভূমিতে নতুন নীতিমালা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গ্রাহকরা নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী এবং উন্নতমানের ভয়েস ও ডেটা সেবা পাবেন। অন্যদিকে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা সহজ শর্তে বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন। সরকার রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, আবার স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র-মাঝারি কোম্পানির জন্যও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি হবে।
যদিও দেশীয় উদ্যোক্তারা শুরু থেকে এর বিরোধিতা করে আসছিল। তারা বলছে, নতুন নীতিমালার কারণে দেশীয় কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাবে। বিদেশি কোম্পানিকে সুযোগ দিতেই নীতিমালা বদল করা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতি যতই সুন্দর হোক না কেন, কার্যকর বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে অনেক নীতি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। অবকাঠামো ভাগাভাগি, গ্রামীণ সম্প্রসারণ এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অপারেটরদেরও আন্তরিক হতে হবে।
পুরোনো নীতির সীমাবদ্ধতা
সরকারের দাবি, ২০১০ সালে প্রণীত আইএলডিটিএস নীতি মূলত রাজস্ব ফাঁকি ঠেকানো, অবৈধ ভয়েস ওভার আইপি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারের ভারসাম্য আনার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই নীতি জটিল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। একাধিক স্তরের লাইসেন্স ব্যবস্থা ব্যবসার শুরুতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসতে নিরুৎসাহিত হন। একই সঙ্গে অবকাঠামো ভাগাভাগির সুযোগ না থাকায় খরচ বাড়ে এবং ভোক্তাদের কাছে মানসম্মত সেবা পৌঁছাতে ব্যর্থ হন অপারেটররা।
নতুন লাইসেন্স কাঠামো
নীতিমালায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে লাইসেন্স ব্যবস্থায়। দীর্ঘদিনের জটিল কাঠামো ভেঙে একীভূত ও সরল কাঠামো চালু করা হয়েছে। এখন থেকে বড় চারটি লাইসেন্স ক্যাটেগরি থাকবে– অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার, ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার, ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার এবং নন-টেরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার। পাশাপাশি টেলিকম-এনাবলড সার্ভিস প্রোভাইডার নামে আলাদা একটি তালিকাভুক্তি ব্যবস্থাও থাকবে, যেখানে বিভিন্ন এসএমএস অ্যাগ্রিগেশন প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারবে।
২০২৭ সাল পর্যন্ত সময়
বিদ্যমান অপারেটরদের ধাপে ধাপে নতুন কাঠামোয় স্থানান্তরিত হতে হবে। নীতি কার্যকরের জন্য তিন ধাপের রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে নীতি কার্যকর ও প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রণয়ন, দ্বিতীয় ধাপে নতুন লাইসেন্স প্রদান ও পুরোনো লাইসেন্সধারীদের ধাপে ধাপে স্থানান্তর, আর তৃতীয় ধাপে ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে সব অপারেটরকে নতুন কাঠামোয় বাধ্যতামূলক রূপান্তর করতে হবে।
বন্ধ হবে শতাধিক দেশি প্রতিষ্ঠান
এই পরিবর্তনের ফলে আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স, এনআইএক্সসহ একাধিক লাইসেন্সধারী শতাধিক দেশি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আইজিডব্লিউ অপারেটরস ফোরামের (আইওএফ), অ্যাসোসিয়েশন অব আইসিএক্স অপারেটরস অব বাংলাদেশ (এআইওবি), আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইআইজিএবি) ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) এই নীতিমালার সমালোচনা করেছে।
তারা বলছেন, নীতিমালায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বৈষম্যমূলক ধারা রাখা হয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বার্থ উপেক্ষা করে খুলে দেওয়া হয়েছে বড় বিদেশি অপারেটরদের একচেটিয়া আধিপত্যের পথ। এতে সরকারের রাজস্ব আহরণ ও দেশীয় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থ ও ডিজিটাল সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, নতুন নীতিমালার মাধ্যমে একক নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে। নিশ্চিত হবে প্রতিযোগিতামূলক সেবা। এতে সরকারের রাজস্ব না কমিয়েও গ্রাহকদের সুলভ মূল্যে সেবা দেওয়া যাবে।
বিনিয়োগ ও মালিকানা কাঠামো
নতুন নীতিমালায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও তা আগের চেয়ে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মোবাইল অপারেটর লাইসেন্সে বিদেশি মালিকানা সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত সীমিত করা হয়েছে, তবে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ দেশীয় অংশীদারিত্ব রাখতে হবে। টাওয়ার ও ফাইবার অবকাঠামো পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানে বিদেশি শেয়ার সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ রাখা যাবে। আন্তর্জাতিক সংযোগ সেবায় বিদেশি বিনিয়োগ সীমা ৪৯ শতাংশের মধ্যে আবদ্ধ করা হয়েছে।
শেয়ার ছাড়তে হবে রবি-বাংলালিংককে
বর্তমানে গ্রামীণফোনের ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ শেয়ার নরওয়েভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টেলিনরের হাতে রয়েছে। বাকি ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ আছে দেশি উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। রবির ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ, পুঁজিবাজারে রয়েছে ১০ শতাংশ। বাংলালিংকের অংশীদারিত্বের শতভাগ দুবাইভিত্তিক ভিওনের কাছে। নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে রবিকে আরও ৫ শতাংশ এবং বাংলালিংককে ১৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হবে।
রবির প্রধান করপোরেট ও রেগুলেটরি কর্মকর্তা শাহেদ আলম বলেন, শুধু নীতিমালা হয়েছে। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা এখনও জানা নেই। তাই এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা উচিত হবে না।
নীতিমালা উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর গত ৪ সেপ্টেম্বর বাংলালিংক এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ‘সংশোধিত টেলিকম নীতিমালা বাধ্যতামূলক মালিকানার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত আমাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।’
ভোক্তার লাভ-ক্ষতি
সরকার দাবি করছে, নতুন নীতিমালায় গ্রাহকরা সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট ও ভয়েস সেবা পাবে। কারণ, অপারেটরদের অবকাঠামো ভাগাভাগি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। তিন বছরের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ারকে ফাইবার নেটওয়ার্কে যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উপকূলীয় অঞ্চল ও দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ওপর দেওয়া হয়েছে জোর। মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট কিউওএস সূচক নির্ধারণ করার পাশাপাশি বিটিআরসি একটি জাতীয় মান পর্যবেক্ষণ ড্যাশবোর্ড চালু করবে।
পরিবেশ ও সাইবার নিরাপত্তা
নতুন নীতিমালায় অপারেটরদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে। টাওয়ার ও ডেটা সেন্টারে সৌরশক্তি বা হাইব্রিড ব্যবস্থা চালুর নির্দেশনা রয়েছে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও কার্বন নিঃসরণ কমানো বাধ্যতামূলক করা হবে। একই সঙ্গে সাইবার হামলা ও তথ্য ফাঁস রোধে নিতে হবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সব অপারেটরকে সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধি মেনে চলার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোতে আলাদা জরুরি প্রতিক্রিয়া দল গঠন করতে হবে।