লুটেরা শ্রেণির সঙ্গে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মিল

কিছুদিন আগেও ভারতীয় গণমাধ্যম ক্রমাগত বাংলাদেশে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বিরুদ্ধ সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য প্রবল উসকানি দিয়েছে। এখনও চলছে। সেটা সফল হয়নি।

ছবি : সংগৃহীত

ফরহাদ মজহার

২৮ মে ২০২৫, ০২:৩১ পিএম

ভারতীয় গণমাধ্যমের এই প্রয়াসকে হাল্কাভাবে নেবার উপায় নাই। এটা বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির– অর্থাৎ মোদীর নীতি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে উসকানির প্রপাগান্ডার বিপরীতে নিদেনপক্ষে আমাদের ভেবে দেখা উচিত দিল্লী যেখান বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাদের পছন্দের কাউকে বসাতে চায়, সেখানে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বিরুদ্ধে কামান দাগানো আমাদের কর্তব্য কি-না? আমরা আগুনে ঘি ঢালছি কেন? সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে উসকে দেওয়া কি কোন বিচক্ষণ নীতি হতে পারে? ভারতীয় গণমাধ্যমের পরিকল্পিত প্রপাগাণ্ডার বিপরীতে সেনাপ্রধানকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করা এবং প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বৃহৎ ও সাংঘর্ষিক করবার রাজনীতি কি ভয়ংকর বিপদ টেনে আনবে না? ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা রটনা এবং ভুয়া তথ্যপ্রচার সেনাবাহিনী ও সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির রাজনীতিতে দিল্লি খুশি হবে। আর আমরা নাকি নিজের পায়ে কুড়াল মেরে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ছি! মহা বীর। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের লজেন্স খুব মিষ্টি লাগে। আমাদের বিপুল আমোদ। বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লীর রাজনীতি বোঝা কি কঠিন? সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উসকে দেবার ভারতীয় দৃশ্যমান ও সরব প্রচারে ভালো দিক হচ্ছে সেনাবাহিনী সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে আগের চেয়ে আরও ঐক্যবদ্ধ। আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ মোটেও কঠিন ব্যাপার না। আশা করি, আমরা সতর্ক হতে শিখব।

 

জিয়াউর রহমানের জন্মদিন আজ

২. শুরু থেকেই সেনাপ্রধান পরিষ্কার বলে আসছেন যে তিনি দীর্ঘকাল সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে রাখতে চান না। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে সেনাবাহিনীর দীর্ঘকাল সেনানিবাসের বাইরে থাকলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি হয়, নানান স্বার্থান্বেষী মহলে সেনা সদস্য ও অফিসারদের বিভ্রান্ত ও ভুল কাজে ফুসলাবার সুযোগ পায়। মনে রাখতে হবে, অভ্যন্তরীণ আইনশৃংখলা পরিস্থিতি রক্ষার শিক্ষা সেনা সদস্যদের নাই। সেটা তাদের দায়িত্বও নয়। তাই তারা ভুল করে বসে এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার অপব্যবহার করে। সেনা সদস্যদের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে পড়ে। জাতীয় সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ে। এক-এগারোর অভিজ্ঞতা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই সেনাপ্রধান এই বক্তব্য নানান সময় দিয়েছেন। বরাবরই দ্রুত নির্বাচন চাইবার এটাই তাঁর প্রধান যুক্তি ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেনাপ্রধান হিশাবে তিনি কেন দ্রুত নির্বাচন চাইছেন সেটা তিনি পরিচ্ছন্নভাবে হাজির করতে পারেননি। লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির দ্রুত নির্বাচন দাবির সঙ্গে তাঁর দাবি মিলে যাওয়ায় মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে।


সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনানিবাসের বাইরে থাকুক- এটা আমরা চাই না। ড. ইউনূস কেন এখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীকে কার্যকর করে তুলতে সক্ষম হলেন না? কেন তিনি দ্রুত নতুন পুলিশ নিয়োগ দিচ্ছেন না? এই অবহেলার তো কোন ক্ষমা নাই। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রধান ক্ষেত্র এই ব্যর্থতার জায়গা থেকেই তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনী পুলিশ নয়। সেনাবাহিনীকে যখন পুলিশ বাহিনী হিশাবে আমাদের নিয়োগ করতে হয় তখন আমরা রাষ্ট্রের বারোটা বাজিয়ে দেবার কাজটাই করি। কিন্তু আমাদের হুঁশ নাই।

৩. চট্টগ্রাম বন্দর এবং মানবিক করিডোর জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামরিক স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। এই সকল বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন, সেটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। সেই ক্ষেত্রেও দূরত্ব তৈরি করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু মাল খালাস করবার জেটি নয়, সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সুরক্ষা নিশ্চিত করা জাতীয় স্বার্থেই জরুরি। সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়াদির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আন্তরিক পরামর্শের গুরুত্ব জনগণ ও সরকার সকলকেই বুঝতে হবে। এই সকল বিষয় আমলে না নিয়ে যারা ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাবাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মীমাংসার পরিবেশ তৈরি না করে আরও দূরত্ব বৃদ্ধি করে চলেছেন, বিনয়ের সঙ্গে আমরা তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমি বারবার এই দূরত্ব দ্রুত কমাবার কথা বলেছি।

৪. কিন্তু সেনাপ্রধান সেনা-দরবারে নির্বাচন নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন আমরা তা সমর্থন করি না। সাবধান, আগুনে ঘি ঢালা যাবে না। প্রথমত সেনাপ্রধান হিশাবে রাজনীতি তাঁর বিষয় নন। তিনি জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের অধীন। আমরাও বারবার জনগণকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে বর্তমান উপদেষ্টা সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর দাঁড়ানো। এই সরকারের আইনি বৈধতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু সেনা সমর্থনের রাজনৈতিক মর্ম হচ্ছে সেনাবাহিনী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের অভিপ্রায়কেই ধারণ করে। সেই তাগিদেই তারা ড. ইউনূস ও উপদেষ্টা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। আমরা এই অবস্থানকে সমর্থন করি।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ও আইনি বৈধতা নিশ্চিত করা আইন উপদেষ্টার কর্তব্য। অতএব, উপদেষ্টা সরকারকে বিপজ্জনক অবস্থায় রাজনীতি ও আইন উভয়দিক থেকে ‘অরক্ষিত’ রাখা এবং সরকারের আইনি বৈধতা নিশ্চিত করবার কোনো প্রয়াস না নেওয়ার দায় ১৬ আনা আইন উপদেষ্টার ওপরই বর্তাবে। আমরা আশা করব, তিনি দ্রুত এই বিষয়ের মীমাংসা করবেন।

৫. লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চাইছে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে তাদের বক্তব্য মিলে যাওয়ায় জনগণের মনে বিস্তর সন্দেহ, আশংকা এবং ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এই ধোঁয়াশা অবস্থা থাকুক আমরা তা চাই না। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু জনগণ নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার চায়। গণমুখি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান চায়। ড. ইউনূস বিদেশি বিনিয়োগের ঝাণ্ডা উড়িয়ে এলিট শ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয়তা চাইছে। এতে জনগণ হতাশ হবে এবং বিশৃংখলা বাড়বে।

৬. সেনাবাহিনীর দ্রুত নির্বাচন চাইবার যুক্তি আর গণভ্যুত্থানের পর লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার মর্ম এক নয়। সেনাপ্রধান সামরিক বাহিনীর ইন্ট্রিগ্রিটি বা সংহতি রক্ষার জন্য দ্রুত নির্বাচন চাইছেন। সৈনিকদের নীতি-নৈতিকতা শক্তিশালী ও অক্ষুণ্ন রাখা সেনাপ্রধান হিশাবে অবশ্যই তাঁর দায়। কিন্তু এটা ভাবা ঠিক নয়, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণি ক্ষমতায় এলেই দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি আপনাআপনি ভালো হয়ে যাবে এবং সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যেতে পারবে। তাই লুটেরা মাফিয়া শ্রেণীর স্বার্থ থেকে সেনাবাহিনীর স্বার্থকে একাকার করে ফেলা যাবে না। অতএব, সেনাপ্রধান এবং সৈনিকদের বুঝতে হবে একমাত্র জনগণই সেনাবাহিনীর অভিভাবক। সৈনিক ও অফিসারসহ আমরা সকলেই জনগণের অংশ। যারা একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ চাই। এই বার্তা স্পষ্ট করতে হবে। জনগণের ঐক্য, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত করার ওপর আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।

অতএব, শুধু প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে দূরত্ব কমালে আমাদের চলবে না। সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যেও আমাদের দ্রুত দূরত্ব কমাতে হবে। সেনাবাহিনী মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি, তারা এ দেশেরই নাগরিক। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ধংস করবার ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জনগণ বরদাশত করবে না। লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে জনগণ গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে সেনাবাহিনীর সমঝোতা, মৈত্রী ও ষড়যন্ত্র হিশাবে দেখছে। এই বিভ্রান্তি নিরসন করতে হবে।

আশা করি, আমরা সকলেই সতর্ক ও সংযত হব। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে গণঐক্য ও গণসংহতির বিকাশ এই সময়ের জন্য জরুরি।

কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক