গণমাধ্যমে শখের চাকরি

যারা পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রায়ই আন্দোলনে সোচ্চার হন, তারা কি শুধু শাড়িপরা নারীর বেলাতেই কথা বলতে বাধ্য? যারা সামাজিক বৈষম্য দূর করতে চায়, তারা কি কখনোই ‘হুজুরদের সমস্যা’ দেখবে না? আমাদের জন্য যথোপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হবে না?

প্রতীকী ছবি

আমিন মুনশি

২৫ জুন ২০২৫, ০৮:০৭ পিএম

কওমি মাদরাসায় লেখাপড়া সমাপ্ত করে মূলধারার গণমাধ্যমে কাজ করছি ২০১৮ থেকে। ক্ষুদ্র এ পথচলায় অনাকাঙ্ক্ষিত বহু ঘটনা ও বৈষম্যমূলক আচরণ স্বচক্ষে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য বেশি পীড়া দিয়েছে। তবুও কেন রয়ে গেছি গণমাধ্যমে? কারণ, এই পেশা আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। শখের চাকরি বলে কথা!


চিন্তা ও তৎপরতায় পরিবর্তন আনতে হবে : ফরহাদ মজহার

এই লাইনে ব্যক্তিগতভাবে অনেক অমুসলিম সহকর্মীকেও আমার বেশ আন্তরিক মনে হয়েছে। ‘হুজুর মানুষ নামাজ পড়বে’, ‘হুজুর মানুষ ওসব খায় না’, ‘হুজুর মানুষ সহজ-সরল’ এ জাতীয় বাক্য তো সবসময় শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু নামকরা ‘মিডিয়া হাউজ’ আছে যারা ইসলাম সংশ্লিষ্ট শব্দের উচ্চারণও যেন সহ্য করতে পারেন না; ধর্মীয় কোনো চলমান ইস্যুতে নিউজ করতে দেখলে তাদের কলিজায় কেউ আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ধর্ম এবং রাজনীতিকে বিভক্ত করে রাখতে পারলেই যেন তাদের জীবন ধন্য (?) এর মধ্যে উচ্চপদস্থ কিছু লোকের মাত্রাতিরিক্ত চুলকানি অত্যন্ত হাস্যকর ঠেকে; তারা যেমন তিলকে তাল বানাতে পারে, আবার তালকে তিল বানিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত করে দিতে পারঙ্গম। মুখোশের আড়ালে মিডিয়ায় কত রূপের মানুষ যে দেখা যায়!


‘পোশাকের স্বাধীনতা’ ‘মুক্তচিন্তা’ ‘মতপ্রকাশের অধিকার’ শব্দগুলো ছাড়া যাদের কোনো বক্তব্য পরিপূর্ণ হয় না, তাদের অফিস রুল দেখলে মনে হয় এসবই ভাঁওতাবাজি। টকশোতে নীতিবাক্য শুনিয়ে এসে নিজেই করেন মাদকের কারবার, গৃহকর্মী নির্যাতন ও সহকর্মী ঠকানোর ফন্দি!

দুই.

২০২২ সালের মাঝামাঝিতে শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে (যেটি বাকশাল আমলেও চালু ছিল) চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। পরে জানতে পেরেছি প্রায় ৫০ জনের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছি আমি। এরপর অফিসিয়ালি ডাকা হলেও শেষ পর্যন্ত আমাকে নিয়োগপত্র দেননি তাঁরা! সম্পাদক-প্রকাশক সারাদিন আমাকে (সাথে ছিল আরেকজন দাড়িওয়ালা যুবক) ওয়েটিংয়ে রেখে ইন্টারভিউয়ের জন্য ভেতরে ডাকেননি। অবশ্য ‘এইচআর’ যিনি ছিলেন তার কথাগুলো ছিল হৃদয়ে দাগ কাটার মতো। শেষ লাইনটা এখনো কানে বাজে—“আপনি তো মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড, তাহলে এতো ভালো বাংলা জানেন কীভাবে!”

এর আগে সেই পত্রিকার অনলাইন এডিটর আমার কাজ দেখেছেন। বাহবা দিয়েছেন। কয়েকদিন ঘনঘন আসা-যাওয়ার ফলে অন্যদের সাথেও সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই সূত্রে একজন আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন—“এখানকার কর্তৃপক্ষ মৌলবাদবিরোধী। তারা হুজুর পছন্দ করে না। আপনি ফর্মাল ড্রেস পরে ইন্টারভিউ দিয়ে আসেন। পরে আমাদের সাথে আপনার পোশাকে অফিস কইরেন।”

নিজের অজান্তেই সেদিন আমার চোখে পানি চলে এলো। কেন এমন বৈষম্য এদেশে? যোগ্যতার বিচারে উত্তীর্ণ হয়েও কোন্ অলিখিত নিয়মে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হলো আমাকে? আমি তো ফর্মাল ড্রেস কী, বুঝতাম না। ডেস্কে বসে কাজ করার সাথে বিশেষ পোশাকের প্রয়োজনীয়তা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। মাদরাসায় মানুষ হয়েছি তো, অতিসাধারণ জীবনযাপন। গণমাধ্যমে কাজ করার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে এসেছি। এর বাইরে আর কিছু জানি না। আচ্ছা, যারা পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রায়ই আন্দোলনে সোচ্চার হন, তারা কি শুধু শাড়িপরা নারীর বেলাতেই কথা বলতে বাধ্য? যারা সামাজিক বৈষম্য দূর করতে চায়, তারা কি কখনোই ‘হুজুরদের সমস্যা’ দেখবে না? আমাদের জন্য যথোপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হবে না?

তিন.

মাদরাসাজগতে বাংলা ভাষার চর্চা তুলনামূলক বেড়েছে। সাংবাদিকতায় কাজ করতে আসছেন অসংখ্য কওমি তরুণ। এরা দুনিয়াবি জটিলতা বুঝে কম। আচরণে দুর্বল। কাউকে ঠকিয়ে, জিম্মি বা চাঁদাবাজি করে চলার সাধ অথবা সাধ্য কোনোটাই এদের ধাতে নেই। এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অগ্রজদের ভাবতে হবে এখনই। প্রকাশ্যে এসব কথা সবিস্তারে বলাও বিব্রতকর। তবে আমার আল্লাহ জানেন ভেতরের কথা। তিনি নিশ্চয়ই উত্তম রিজিকের বন্দোবস্ত করবেন। নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন ক্বারিব।

পুনশ্চ: প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে এখন ইসলাম বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামি কন্টেন্ট বেশি পছন্দ করেন। আর তাই দর্শক টানার লোভে বহু মালিকপক্ষ বাধ্য হয়েই ‘ধর্মব্যবসা’য় নেমে গেছেন। তবে সরলমনা আমরা যারা সত্যের খুব কাছাকাছি থেকে তথ্যসেবায় কাজ করতে চাই, আমাদের আরও হিকমতের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।

লেখক : সহ-প্রচার সম্পাদক, জাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

চাঁদাবাজি
সাংবাদিকতা
কওমি
বৈষম্য
গণমাধ্যম