অভিজাত এলাকায় বৈধ বারে অবৈধ ব্যবসা রমরমা

বনানীতে হোটেল সারিনা ও ব্যারন্স বারে চলছে নানা অনিয়ম

প্রতীকী ছবি

অনুসন্ধান টিম

১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১১ এএম

রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে চলছে বৈধ-অবৈধ বারের রমরমা বাণিজ্য। রাতের আধাঁরে শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে বারগুলো তখন রঙিন আলোয় ঝলমল করে ওঠে। রকমারি রঙিন পানির উৎসবে মেতে ওঠে অপ্রাপ্তবয়স্ক হোক অথবা প্রাপ্তবয়স্ক। লাল-নীল বাত্তির আলোয় রঙিন পানির চুমুকে একটুকরো হালকা মিউজিকের সঙ্গে রমণীর নৃত্যে ফোটে ঠোটে বাঁকা হাসি। দেখে যেন মনে হয় কোনো রাজপ্রাসাদের নর্তকীখানা অথবা রাজমহলের খাস কামরা।


প্রেমের টানে তুরস্কের যুবক বাংলাদেশে

এ দেশে আইন আছে, কিন্তু আইনের তোয়াক্কা নেই। এসব বারের লাইসেন্স থাকলেও আইনকে দেখাচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি। আইনের রক্ষকদের নাকের ডগায় প্রকাশ্যেই চলছে এসব। হাত বাড়ালেই বারগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে মদ আর নারী। পারমিট থাক বা না থাক তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কথায় আছে, টাকা হলেই মেলে বাঘের চোখও। এ তো মদ!


দৈনিক আওয়ার বাংলাদেশ পত্রিকার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর বনানী এলাকায় হোটেল সারিনায় ও ব্যারন্স বারে চলছে নানা অনিয়ম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যারন্স বারের অনুমতি ভবনটির চতুর্থ তলায় থাকলেও অতিরিক্ত আরো একটি ফ্লোরে চালাচ্ছে অবৈধ রমরমা বাণিজ্য। নির্ধারিত সময়ের পরও চলতে দেখা যায় এসব বার।

এসব বারে প্রবেশ পথেই থাকে দালালদের চটকদার সব অফার। বেচাকেনা হয় শুধু মদই নয়; বরং নারীর শরীরও। এসব দালালদের সঙ্গে খদ্দেরকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে বারের সিকিউরিটি গার্ডরাও। বারে ঢোকার আগেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দলের সদস্যকে জানায়, ভেতরে সুন্দরী নারীর ব্যবস্থা আছে। টাকা দিলে তিনি একান্তে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। ওই বারের সিকিউরিটি গার্ড বলেন, ‘এখানে নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই। সবকিছু ম্যানেজ করেই এখানে এসব চলে।’ তিনি জানান, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কেউ এখানে খদ্দেরকে কোন প্রকার হযরানি করে না। দালাল আর গার্ডের কথায় আশ্বস্ত হয়ে এবার অনুসন্ধানী দল প্রবেশ করলো বারের ভেতরে। সেখানে গিয়ে চোখ কপালে উঠলো। বারের ভেতরে রয়েছে আলো ঝলমলে রঙ্গমঞ্চ। চলছে নর্তকীদের কোমর দোলানো নাচ। মঞ্চের সামনে টেবিলে টেবিলে শোভা পাচ্ছে দেশি-বিদেশি হরেক রকম মদ। তবে টেবিলে বসে থাকা সবারই নেই পারমিট। অর্থাৎ চাইলে যে কেউ নিরাপদে ঢুকতে পারেন বারের ভেতর। আবার অনেকেই রয়েছেন অপ্রাপ্তবয়স্ক।

দেখা গেলো, দর্শকের সারি থেকে রঙ্গমঞ্চে নারীর শরীরে ছুঁড়ে মারা হচ্ছে টাকা। আর এই টাকার বিনিময়ে মিলছে নির্ধারিত সময়ের জন্য খাস কামরা। যেখানে নারীর সঙ্গে সময় কাটানো যায় একান্তে। টেবিলে বসার কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের অনুসন্ধানী টিমের কাছে এলো ওয়েটার। অফার করলো একান্তে সময় কাটানোর জন্য সুন্দরী নারী রয়েছে তাদের কাছে। টাকা দিলে ব্যবস্থা করে দেবেন। এসবে ‘কোনো আইনি ঝামেলায় পড়তে হবে না’ বলেও পরিস্কার জানিয়ে দেন তিনি।

পারমিট ছাড়া কীভাবে মদ বিক্রি করছেন- জানতে চাইলে বার কর্তৃপক্ষ বলেন, এখানে পারমিটের দরকার হয় না। এ সময় ক্রয়কৃত মদের রশিদ চাইলে তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, এটা যাদের নামে পারমিট আছে, কেবল তাদেরকেই দেওয়া হয়। পারমিট ছাড়া বিক্রিত মদগুলোর রশিদও যাদের নামে পারমিট আছে তাদের নামে দেখানো হয়। এসব ‘আইন পরিপন্থি’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আইনকে ম্যানেজ করেই এসব করি। ফলে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আসে। আমরা টাকা দিয়ে তাদের ম্যানেজ করি। এভাবেই চলতে হয়। আর এ ভাবেই চলে।’

অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যেই নিয়ম রক্ষার জন্য দু’একটি দায়সারা অভিযান পরিচালনা করেই নিজকে দায়মুক্ত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অপরাধীরা। কথায় আছে, আইনের হাত অনেক লম্বা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এদের হাত কি তার থেকেও লম্বা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা উপস্থিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান দৈনিক আওয়ার বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রচলিত আইন মেনেই বার পরিচালনা করতে হবে। কেউ আইনের লঙ্ঘন করলে সে যত ক্ষমতাবান হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কেউ যদি আমাদের কাছে কোনো বারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন, আমরা অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

এ বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষক ও আইনের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন দৈনিক আওয়ার বাংলাদেশকে বলেন, ‘মদের বারে নারীদের দিয়ে নৃত্য করানোর কোনো পারমিট দেওয়া হয় না। কেউ যদি আইন না মেনে মদের ব্যবসা করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। পুলিশ রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রয়েছে। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। অবৈধ কার্যকলাপ চলার পেছনে বিভিন্ন সংস্থার লোক জড়িত রয়েছে। ফলে অপরাধ করেও সহজেই এরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। এসব অপরাধকর্ম সমাজ, দেশ ও প্রজন্মকে বিপদগামী করছে। এগুলো রোধ করা খুবই জরুরি।’

জানতে চাইলে পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তালেবুর রহমান দৈনিক আওয়ার বাংলাদেশকে বলেন, ‘মদের বারগুলোর তদারকি করে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে কেউ যদি কোনো বারের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

মদ
রমণী
অপরাধ
নিরাপত্তা