রাজধানীজুড়ে অবৈধ সিসার রমরমা বাণিজ্য
আইনে সিসা সেবন এবং বিক্রি নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্টের সিসা লাউঞ্জগুলোতে হরদমে বিক্রি হচ্ছে মাদক পণ্য সিসা। এসব সিসা বারে রঙিন নেশায় রাত কাটাচ্ছেন উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা...

ছবি : আওয়ার বাংলাদেশ
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২৬ পিএম
রাজধানীতে গড়ে উঠেছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। বিকাল গড়িয়ে রাত হতেই জমজমাট হয়ে ওঠে মাদকসেবীদের মিলনমেলা। চারদিকে লাল-নীল আলোর ছড়াছড়ি আর হৈ-হুল্লোড়। এমন পরিবেশে সোফায় বসে বড় বড় হুক্কায় সিসা টানছে তরুণ-তরুণীরা। একটু পরপরই হাতবদল হচ্ছে হুক্কা। গানের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে হুক্কায় সিসা টানার গভীর নেশা। চার দেয়ালের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ধোঁয়া। অভিজাত পরিবারের তরুণ-তরুণীদের কাছে নেশার নতুন উন্মাদনা হুক্কায় সিসা টানা।

নিজের কাজে ফিরতে চান ড. ইউনূস
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সিসা একটি নিষিদ্ধ মাদক পণ্য। এই আইনে সিসা সেবন এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেল ও রেস্টুরেন্টের সিসা লাউঞ্জগুলোতে হরদমে বিক্রি হচ্ছে মাদক পণ্য সিসা। এসব সিসা বারে রঙিন নেশায় রাত কাটাচ্ছেন উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, রাজধানীর পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর, বারিধারা, গুলশান, বনানী ও উত্তরায় শতাধিক অবৈধ সিসা বার রয়েছে।
উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের জন্মদিন কিংবা যেকোনো উদযাপন উপলক্ষে পার্টিগুলোর রঙিন আকর্ষণ এখন সিসা সেবন। আগে রাজধানীর হাতে গোনা দু’একটি এলাকায় সিসা বারে বুঁদ হয়ে থাকতেন তরুণ-তরুণীরা। রেস্টুরেন্টের আদলে গড়ে ওঠা এসব সিসা বার বা লাউঞ্জে শুরুর দিকে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের যাতায়াত থাকলেও এখন প্রায় সব শ্রেণির তরুণ-তরুণীর আনাগোনা বাড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সিসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইনে সিসা বার পরিচালনা ও সেবন সম্পর্কিত অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া নগদ অর্থদণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে। তবে তাতেও বন্ধ করা যাচ্ছে না সিসা বারগুলো।
দৈনিক আওয়ার বাংলাদেশ পত্রিকার প্রকাশ টিমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অনুসন্ধানের শুরু বনানীর ‘সেলসিয়াস’ নামে সিসা লাউঞ্জ থেকে। বন্ধ দরজা ভেদ করে সুবাস মিশ্রিত ধোঁয়া এসে পড়ছে লবিতে। দরজায় লেখা সেলসিয়াস। ভেতরেও অল্প আলো, তার মধ্যেই ধোঁয়া আর ধোঁয়া। চলছে হিন্দি গান। সাজানো সোফা সেট। কোনোটিতে মেয়ে আবার কোনোটিতে ছেলে। সবার হাতেই সিসার পাইপ। পাইপ টেনে ধোঁয়া ছাড়ছেন, উল্লাসে মাতছেন। এমন দৃশ্য শুধু সেলসিয়াসে নয় বরং রাজধানীর অভিজাত এলাকাজুড়েই রয়েছে বৈধ-অবৈধ সিসার বার। তবে এসব লাউঞ্জে শুধু সিসা নয়, পাওয়া যায় বিয়ার বা মদও। এ সমস্ত বিষয়ের প্রমাণ মিলাতে প্রকাশ টিম ঘণ্টাখানেক বসার পর নিজেরাই অর্ডার করেন বিয়ার। বিয়ারের বোতল ভেঙ্গে গ্লাস দেওয়া হয়। এ সময়ে অনুসন্ধানী দল প্রমাণ মিলাতে ওয়েটারের সাথে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে বোতল এনে দেখানো হয় এটি বিয়ারই।
এছাড়া বনানীর সি ব্লকের ১১ নম্বর সড়কে ‘অ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্ট’ নামে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে। রাত যত গভীর হয়, তরুণ-তরুণীর ভিড় ততই বাড়তে থাকে সেখানে। অবৈধ এসব সিসা লাউঞ্জে নেই কোনো নিয়মের তোয়াক্কা। গভীর রাত পর্যন্ত এখানে আড্ডা চলে তরুণ-তরুণীর। চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। ক্ষণিকের সঙ্গী করতে অর্থের বিনিময়ে খুব সহজে নারীসঙ্গী পাওয়া যায় এসব সিসা লাউঞ্জে। অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু সিসা লাউঞ্জে বিয়ারও বিক্রয় করতে দেখা গেছে। এসব অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে প্রকাশ টিমের কাছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে বনানী, গুলশান, উত্তরা ও ধানমন্ডি এলাকায় এমন লাউঞ্জ রয়েছে ২০টির বেশি। প্রকাশ টিম অন্তত ১০টি সিসা লাউঞ্জ ঘুরে প্রতিটিতেই প্রায় অভিন্ন চিত্র দেখতে পেয়েছে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশ্যেই চলছে সিসার কারবার। দেখেও না দেখার ভান করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি তিনটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয়। যে তিনটিতে অভিযান চালিয়েছিল সেগুলো এখনও চলছে। শুধু তাই নয়, এর আশপাশেও একাধিক সিসা লাউঞ্জ চলছে।
নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বনানী এলাকার সিসা লাউঞ্জের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, লাউঞ্জ থেকে ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিমাসে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। এছাড়া থানা পুলিশও টাকা পায়। এক প্রশ্নের জবাবে একটি লাউঞ্জের একজন কর্মী নাম বলেন, ‘বোঝেন না, তিনটিতে অভিযান চালানোর পর কেন অন্যগুলোতে অভিযান চলেনি?’ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রকাশ টিম হাজির হয় ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর বিভাগের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ এর কাছে। নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানে ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো থেকে আলামত জব্দ করে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয় বনানীর ই আমি ব্লকে ‘আল গ্রিসিনো রেস্টুরেন্ট’ নামের সিসা লাউঞ্জে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। সেখান থেকে ৫ কেজি সিসা জব্দ করা হয়। লাউঞ্জটির মালিক জহিরুল ইসলাম সিমু। প্রকাশ টিমের অনুসন্ধানে দেখা মিলে, আল গ্রিসিনো রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে সিসা বিক্রি করে। লাউঞ্জটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোলা হয়। চলে ভোর পর্যন্ত। এর পাশের ভবনের আটতলায় ‘মারবেলা’ নামে একটি সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। ই-ব্লকের আরেকটি ভবনের ছয়তলায় গিয়ে দেখা যায়, ‘হেজ রেস্টুরেন্ট’ নামের প্রতিষ্ঠানের সিসা বেচাকেনা চলছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে বাস্তবে দেখা গেছে নানা অনিয়মের চিত্র। অবৈধ মাদক কারবারি এবং সিসা বারগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা সিসা বারের কোনো লাইসেন্স দিই না। তবে যদি কেউ অবৈধ মাদকের ব্যবসা করে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সিসাতে যদি ০.২ পার্সেন্টের বেশি নিকোটিন থাকে তবেই সেটিকে মাদক বলে গণ্য করা হয়। ফলে যারা মাদকের অপব্যবহার করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি বা অ্যাকশনে যাই।’